আমার চশমাজীবন ষাট বছরের হবার কথা ছিল। কিন্তু নিজের তৈরি করা ফাঁদে সাতটি বছর চাপা পড়েছে, আমার প্রকৃত চশমা বয়স ৫৩ বছরের। দূরের জিনিস কম দেখছি বুঝতে পারছি, কিন্তু বলছি না কারণ তাতে আমার একটি আংশিক প্রতিবন্ধী দশা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। ব্যাপারটা যাতে ধরা না পড়ে, সে জন্য স্কুলে আগে আসতাম, বসতাম ফার্স্ট বেঞ্চে, যেনো ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডের কোনো লেখা আমার দৃষ্টি ফসকে না যায়। তিনটি স্কুলে পড়েছি: ক্লাস ওয়ানের মধ্যভাগ থেকে ক্লাস ফাইভ রাজাবাজার রোটারি প্রাইমারি স্কুল; ক্লাস সিক্স ও ক্লাস সেভেন অর্ধেক ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ (এখন নাম বিজ্ঞান কলেজ, তখন আমাদের শিক্ষকদের একজন ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, পরে তিনি ঢাকা কলেজে আবারও আমার শিক্ষক) এবং মধ্য সেভেন থেকে শুরু করে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত গর্ভনমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল।
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় দূরের জিনিস অস্পষ্ট দেখার কথা বলেছিলাম; তখন জবাব পেয়েছিলাম, চশমা পরে ‘ফুটানি’ করতে হবে না। প্রথম দুটি স্কুলে মূলত বাসা থেকে নৈকট্যের কারণে প্রথম সারির বেঞ্চে বসা নিশ্চিত করতে পারতাম। কিন্তু ল্যাবরেটরি স্কুলে যোগ দেবার পর দূরত্ব বেড়ে যায় এবং প্রায়ই আমাকে শেষের দিকে বসতে হয়। পাশের বন্ধুটির সাথে চুক্তি হয়: বোর্ডের প্রশ্নটা আমি তোর খাতা দেখে টুকে নেব। তুই চাইলে আমার খাতা দেখে উত্তর লিখবি। আমাদের এই দেখাদেখির একপর্যায়ে শিক্ষক পশুপতি দে আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে বললেন, খাতা দেখে লিখছিস কেন? অপমানিতও বোধ করলাম।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে আম্মাকে বললাম, আমি বোর্ডের লেখা দেখতে পাই না, দূরের জিনিস ভালো দেখি না। আম্মা জানালেন আব্বাকে। আমাদের পারিবারিক আমলাতন্ত্রটা এমনই ছিল, আম্মার মাধ্যমে আব্বার কাছে পৌঁছতে হতো। পরে সুবিধামতো সময়ে আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন সেকালের চোখের বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওয়াদুদের কাছে। চশমা যাদের নিতে হবে এমন দুজন করে রোগী ভেতরে ঢুকাতেন, একজন দূরে দেয়ালে ওপরের দিকে টাঙানো হরফগুলো পড়তেন প্রথমে খালি চোখে, তারপর চশমা দিয়ে। দেয়ালে টাঙানো তিনটি হরফ বোর্ড: ইংরেজি, বাংলা এবং ডানে-বাঁয়ে কিছু চিহ্নযুক্ত আর একটা ওপর থেকে ক্রমান্বয়ে হরফ ছোট হয়ে আসছে। যখন আমার পালা এল, আমি নির্দ্বিধায় পড়ে ফেললাম:
E
F P
T O Z
L P E D
P E C F D
সম্ভবত আর একটা লাইন। ডাক্তার ওয়াদুদ আব্বাকে বললেন, চোখ ঠিকই আছে। ছেলেকে গুঁড়া মাছ আর শাকসবজি খাওয়াবেন। আব্বা বললেন, কিন্তু সে তো কেঁদে কেঁদে তার মাকে বলেছে, ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা দেখতে পায় না, স্কুলে বকা খায়।
ডাক্তার সাহেব পরক্ষণেই আমাকে আবার বসিয়ে বললেন, এবার বাংলা বোর্ডের হরফগুলো পড়ো। আমি কোনোভাবে চোখ কচলে কেবল একটা হরফ পড়তে পারলাম। তিনি বললেন, ইংরেজির ৫ লাইন পড়তে পারলে বাংলার ৫ লাইন অবশ্যই পড়তে পারবে।
কিন্তু আমি কোনোভাবেই দুই লাইনের বেশি পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত তিনিই ধরে ফেললেন এবং আব্বাকে বললেন, আপনার পণ্ডিত ছেলে যখন মাঝামাঝি জায়গায় বসেছিল ইংরেজি বোর্ডটা মুখস্ত করে ফেলেছে, বাংলাটার ওপর নজর দেয়নি।