Sunday, December 10, 2023

বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কতটুকু প্রাসঙ্গিক

তারিখ:

বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য সাড়ে সাত দশক আগে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও সংস্থাটি বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা এবং কর্তৃত্ব হারিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এর সর্বশেষ উদাহরণ।

আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজার রাখার জন্য ১৯৪৫ সালে ৫১টি দেশ নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশই এর সদস্য। তবে আগের বহু সংকটের ধারাবাহিকতায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকানো কিংবা সংকটের সমাধানে সংস্থাটি দর্শনীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল। একইভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অনেক সহিংস সংঘর্ষের ঘটনায়ও জাতিসংঘকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং মানবিক সংকটে সময়মতো হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারিতেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি। কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে।

 

এ রকম শত সমালোচনার মধ্যেই আজ পালিত হচ্ছে জাতিসংঘ দিবস। দিবসটি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে অবশ্য জাতিসংঘকে ‘আশার ফসল’ বলে অভিহিত করেছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

বিশ্নেষকরা বলছেন, জাতিসংঘকে আরও বিশ্বাসযোগ্য সংস্থায় পরিণত করতে হলে এর সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় বিশ্বব্যাপী আইনের শাসন ভেঙে পড়বে। জাতিসংঘের পতন হলে দুর্বল দেশগুলোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী দেশগুলোর আগ্রাসনের আরও বহু ঘটনা ঘটবে এবং বিশ্বকে তা আরও বেশি অস্থির, সহিংস এবং বিশৃঙ্খল করে তুলবে।

বিশ্নেষকদের মতে, জাতিসংঘের তিনটি কেন্দ্রীয় দুর্বলতা রয়েছে। একটি হলো নিরাপত্তা পরিষদ। পাঁচটি স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। তারা প্রায়ই মানবজাতির সাধারণ স্বার্থের পরিবর্তে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের জন্য তাদের এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া থেকে মিয়ানমারকে রক্ষা করতে চীন তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ এবং সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে গত ফেব্রুয়ারিতে মস্কো ভেটো দেয়। তিব্বত, হংকং এবং তাইওয়ানে চীনের ভূমিকার সমালোচনার বিরুদ্ধে বেইজিং তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছে। কাশ্মীরে ভারতের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করছে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। অন্যদিকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বরতা বন্ধের যে কোনো প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগে।

দ্বিতীয় দুর্বলতা হলো সংস্থাটির প্রধানসহ অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদেরও নিয়োগ করে স্থায়ী সদস্যরা। জাতিসংঘ ব্যবস্থার তৃতীয় দুর্বলতা হলো, যেভাবে এটি পরিচালনা করা হয়। এটা অস্বচ্ছ এবং জবাবদিহিহীন বলে সমালোচিত হচ্ছে। স্থায়ী সদস্যদের যে কোনো একটির ভেটো যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব বাতিল করে দিতে পারে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার এবং জাতিসংঘে জর্ডানের সাবেক রাষ্ট্রদূত জেইদ রাদ আল হুসেইন প্রস্তাব করেছেন, সাধারণ পরিষদে সুপার সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে ভেটো ক্ষমতা নাকচ হওয়া উচিত।

স্পষ্টত, স্থায়ী সদস্যরা তাদের ভেটো ত্যাগ করার দাবিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তবে জাতিসংঘকে আরও প্রাসঙ্গিক করতে হলে একে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। সীমিতসংখ্যক দেশের জন্য ভেটো ক্ষমতার ধারণা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা উচিত। ভেটো শুধু অন্যায্য নয় এবং এটি কাউন্সিলের কার্যকারিতাকেও পঙ্গু করে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জাতিসংঘের গণতন্ত্রীকরণের জন্য অবশ্যই স্থায়ী সদস্যদের বিশেষ ক্ষমতাকে বিলুপ্ত করতে হবে। জাতিসংঘের সংস্কার অবশ্যই এই ভিত্তিতে হতে হবে যে, প্রতিটি দেশের সমান ক্ষমতা থাকবে এবং প্রতিটি দেশের ভোট সমান মর্যাদা পাবে।

নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার আধুনিক যুগের ভূরাজনীতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কীভাবে গণতন্ত্র এবং প্রতিটি দেশে সমান অধিকারের কথা বলতে পারে, যদি সেখানে বিশ্বব্যাপী জনমতের প্রতিনিধিত্ব বা সমান অধিকার না থাকে?

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও স্বীকার করেছেন, এ সংস্থাটি এখন অভূতপূর্ব পরীক্ষার মুখোমুখি। কিন্তু জাতিসংঘ এ রকম কিছু মুহূর্তের জন্যই তৈরি হয়েছিল। তাঁর অভিমত, এ সংস্থাকে বিশ্বে সংঘাতের অবসান, চরম দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাস এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা উদ্ধারে কাজ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি আসক্তি ভাঙার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিপল্গব শুরু করে এ গ্রহকে রক্ষা করতে হবে। নারীদের জন্য সুযোগ ও স্বাধীনতা এবং সবার জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে এ সংস্থাকে। সূত্র : ডেইলি মেইল/গার্ডিয়ান

জনপ্রিয় সংবাদ