দেশ ও বিদেশে মধুর চাহিদা বাড়ছে। ফলে প্রাকৃতিক উৎস কম হওয়ায় দেশি উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন করছেন। বর্তমানে দেশে যে মধু উৎপাদিত হচ্ছে তার ৯৫ শতাংশই আসছে চাষ থেকে। বাকি ৫ শতাংশ প্রাকৃতিক উৎপাদন থেকে আসছে।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন বাড়ার ফলে রপ্তানির বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বাণিজ্যিকভাবে দুই হাজার ৫০০ মৌ খামার রয়েছে। তাদের প্রায় দেড় লাখ মৌ বাক্স রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদিত হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়। চলতি অর্থবছরে সরিষার চাষ বেশি হওয়ায় ২০ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত বছরের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ উৎপাদন কমে ১০ হাজার মেট্রিক টন হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এখনো সরিষার মাঠ থেকে মধু আহরণ করছেন চাষিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাষিরা সরিষা, লিচু, কালিজিরা, ধনিয়া, বরই, সূর্যমুখীসহ সুন্দরবন ও পাহাড়ি বিভিন্ন ফুল থেকে সারা বছর মধু সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) মৌ চাষের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি চাষিদের উৎপাদিত মধু বাজারজাতকরণে সহায়তা করে যাচ্ছে। প্রতিবছর উৎপাদিত ৫০০ থেকে ৬০০ মেট্রিক টন মধু ভারত, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চাষিরা এখন রপ্তানির জন্য বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষে ঝুঁকছেন। প্রতিবছর দেশের মৌ খামারগুলো থেকে এক লাখ টন মধু আহরণ করা সম্ভব, সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বিসিক। মধুর উৎপাদন বাড়াতে মৌ চাষিদের প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় উন্নয়নে যৌথভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কাজ করছে বিসিক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৌ চাষি ফাউন্ডেশনের সভাপতি, মধু চাষি ও হানি বাংলাদেশ প্রসেসিং প্লান্টের মালিক মো. এবাদুল্লাহ আফজাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা বছর যা মধু উৎপাদিত হয় তার ৮০ শতাংশই আসে সরিষার ফুল থেকে। শৈত্যপ্রবাহের কারণে মৌ মাছি ফুল থেকে ঠিকমতো মধু নিতে পারছে না। তাই এ বছর মধুর উৎপাদন কিছু কমে গেছে। তবে আশা করছি, এ বছর লিচু ও সুন্দরবন থেকে পর্যাপ্ত মধু উৎপাদন করতে পারব। আমি বর্তমানে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় সরিষা থেকে মধু সংগ্রহ করছি। তবে আবহাওয়া ভালো না থাকায় তেমনভাবে মধু সংগ্রহ হচ্ছে না। কিছু আগে মানিকগঞ্জের পুকুরিয়ায় মধু সংগ্রহ করেছি। যেখানে ফুল থাকে, সেখানেই আমরা মধু সংগ্রহ করি। ’
এবাদুল্লাহ আফজাল বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে আমাদের মধুর চাহিদা রয়েছে। এ বছর ভারতে রপ্তানির জন্য আমি ২০০ মেট্রিক টনের একটি অর্ডার পেয়েছি। এরই মধ্যে ১৬৫ টন সংগ্রহ হয়েছে। বাকি ৩৫ টন সংগ্রহ হলেই রপ্তানি করতে পারব। ’
বিসিকের মৌ চাষ উন্নয়ন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে এ প্রকল্পের দায়িত্বরত খন্দকার আমিনুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সাধারণত বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করি। প্রতিবছর নভেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত সরিষা থেকে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কালিজিরা থেকে, মার্চে লিচু থেকে এবং এপ্রিলে সুন্দরবন থেকে আমাদের মৌ চাষিরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাক্সে চাষ করে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। চাষিরা ভ্রাম্যমাণ এই খামারগুলো পরিচালনা করেন। যখন যেখানে যে ফুলের সংস্থান হয়, সেখানে বাক্সগুলো নিয়ে মধু সংগ্রহ করেন। ’
তিনি বলেন, ‘এ বছর সরিষা ফুল ফোটার সময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় অনেক ফুল নষ্ট হয়ে যায়, যার কারণে সরিষা থেকে মধু সংগ্রহ কম হয়েছে। ফলে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মধু উৎপাদন কম হবে। গত অর্থবছরে ১২ হাজার টন মধু উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে সরিষা থেকেই প্রায় ছয় হাজার টন মধু পেয়েছিলাম। চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার টন উৎপাদিত হতে পারে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে ২০০ থেকে ৩০০ টন মধু উৎপাদিত হয়। সরিষা থেকে ৮০ শতাংশ মধু আসে। বাকি ২০ শতাংশ আসে অন্যান্য ফুল থেকে। ’
রপ্তানির বিষয়ে মৌ চাষ উন্নয়ন প্রকল্পের সাবেক এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মধুর বিশ্বের অনেক দেশেই চাহিদা রয়েছে। ভারত, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে মধু রপ্তানি হচ্ছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মধু রপ্তানি করছে। এর মধ্যে এপি হানি, ট্রপিকা হানি, হানি বাংলাদেশসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ টন মধু রপ্তানি করে। মধু চাষের জন্য সর্বপ্রথম বিসিক ১৯৭৭ সালে কার্যক্রম শুরু করে। পরে বিসিকের হাত ধরেই এ দেশে মধু উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে। বিসিকের ঢাকার ধামরাইয়ে আন্তর্জাতিক মানের একটি মধু প্রসেসিং প্লান্ট রয়েছে। সেখানে খুবই স্বল্পমূল্যে মধু প্রসেস করে দেওয়া হয়। এর ফলে মধু দীর্ঘদিন সংগ্রহে থাকে। আগে প্রসেসিংয়ের অভাবে অনেক মধু নষ্ট হয়ে যেত। এখন এই প্রসেস থেকে বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগী মধু সংগ্রহ করে বাজারজাত করছে। দেশে এখন মধু নীতিমালা তৈরি করা জরুরি হয়ে গেছে। নীতিমালার আলোকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গুণগত মান বজায় রেখে মধু উৎপাদন করা হবে, যাতে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যায়। ’